নভেম্বার ২৯, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

+৮৮০১৭৪৪-২২১৩৮৫

বখরা ঈদ  

  • Views: 1274
  • Share:
জুন ১৭, ২০২৪ ০৫:৩৯ Asia/Dhaka

রুহুল আলম:: কুরবানীর ঈদ কে বখরা ঈদ নামে বেশি প্রচলিত আমাদের অঞ্চলে। আজ খুবি মনে পড়ছে সেই সব দিনের কথা। আশি / নববই দশকের সেই সব বখরা ঈদেরস্মৃতি আজ বড়ই মনে পড়ছে তাই লেখার মাধ্যমে সবার সাথে শেয়ার করার চেষ্টা।

সাধারণত ঋতু ভেধে এই আনন্দ ভিন্ন রকম হতো। বর্ষায় যেরকম আনন্দ পাওয়া যেত সেটা শীত কালে তার চেয়ে ভিন্ন। বর্ষায় বৃষ্টি এবং বন্যার মধ্যে কুরবানী দেয়ার সময় আমাদের আনন্দের চেয়ে কষ্টটাই বেশি হতো। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় ছিল কোরবানির মাংস সবার বাড়িতে পৌঁছে দেয়া। সেই দায়িত্বটা আমাদের মত বাড়ির ছোটদের ছিল। সবার নামের তালিকা  ধরে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া ছিল একটি বিরক্তিকর কাজ। আবার শীতের সময় খুব ভোরে ফজরের সময় গোসল করা কিংবা নতুন কাপড় অন্যদেরকে দেখানোর জন্য শীতের কাপড় না পড়ার কষ্টটা এখনো কষ্ট দেয়।

রাতে সাধারণত ঘুমাতাম না বা অল্প কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ফজরের আযানের আগেই উঠে যেতাম। আশেপাশের দুই তিন বাড়ির  ছেলে মেয়ে আমরা খুবই মজা করে রাত কাটাতাম। সাধারনত লুডু খেলেই বেশি সময় পার করতাম। অপেক্ষা করতাম কখন ফজরের আযান হবে আর পানিতে গিয়ে গোসলের জন্য ঝাঁপ দিব। যে সবার আগে ঝাঁপ দিবে তার ছিল অসাধারণ কৃতিত্ব। পরের তিনদিন পর্যন্ত সে এই গল্প করে বীরত্ব দেখাতো। তারই সাথে দ্বিতীয়, তৃতীয়রা তাল মিলাত। 

সকালে নামায শেষ করে সবাই কুরবানী দেয়ার জন্য তাড়াতাড়ি ছুটতো । বড়রা তখন ছোটদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দিয়ে যেতেন যাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসার জন্য। কিন্তু আমরা ঈদের মেলা থেকে সেই প্রিয় খেলনা গুলা কিনতে এবং সেগুলা বাজিয়ে বাড়িতে আসার তালে তালে সেই নির্দেশ গুলো ও অকাতরে ভুলে যেতাম। তবে আসার পরে বকুনি খেতেহবে সেটা বাড়ির পাশে আসার পরে মনে পড়ত।

সাধারণত আমরা দুই-তিন বাড়ির ছেলেমেয়েরা একই সাথে ঈদের আনন্দকে বেশি ভাগাভাগি করতাম। নামাজে যাওয়ার সময় বের হলে বাজারের আশপাশে গেলে তখন অন্য পাড়া বা গ্রামের অন্যান্যের সাথে দেখা হতো। ঈদের নামাজের পরে কোলাকুলি ছিল অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটু বড় হলে অন্যান্যদের বাড়ি গিয়ে পিঠা খাওয়া ছিল আমাদের ঈদের অন্যরকম কার্যক্রম। তখন গ্রামের মধ্যে ফ্রিজের প্রচলন ততটা ছিল না । সবার বাড়িতে বড় বড় ডেগ, ডেগছি  থাকতো যাতে সবাই কুরবানির মাংস গরম করে রাখতে পারেন।তাড়াতাড়ি মাংস খেয়ে শেষ করাই ছিল অন্যতম লক্ষ্য যাতে করে মাংস নষ্ট না হয়। এজন্য কোরবানির পরবর্তী কয়েক দিন পর্যন্ত শুধু মাংস খেতে হতো ইচ্ছার বাইরে। এরপরে আরো মিনিমাম তিন মাস  মাংস খাওয়ার প্রতি কোন টান থাকতো না। 

সকালের গোসলের পরে আমরা সাধারণত তেল মাখতাম না, বিশ্বাস ছিল এতে করে পুল সিরাত পিচ্ছিল হয়ে যাবে যাতে আমরা বেহেশতে যেতে পারবো না। চই পিঠা  ছিল কোরবানির ঈদের অংশ, এখনো আছে। গুড়ের হান্দেশ কুরবানীর ঈদে  রাজত্ব করতে পারত না কারণ ছিল গোসতের সাথে চই পিঠা অনেক জনপ্রিয় ছিল। 

মাংসগুলোকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হতো। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় ছিল আত্মীয় সজনের অংশগুলোকে দূরদূরান্তে নিয়ে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব ছিল আমাদের উপর। এখনকার মতো যাতায়াত ব্যবস্থায এতো ভালো ছিল না বেশিরভাগসময়ে হেঁটে বা বাইসাইকেলে যাওয়া হতো। চামড়াগুলা মাদ্রাসায় পৌঁছে দেয়া দায়িত্বের মধ্যে পড়তো। এটা ছিল সবার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম। আমাদের এলাকার মাদ্রাসা এখনো সবার একটি আবেগের স্থান। 

কোরবানির পশুর কলিজার মাংস দিয়ে প্রথমে ভাত খাওয়া কে সওয়াবের কাজ মনে করা হতো। যারা মাংস খেত না তাদেরকেও কোন ভাবেএক টুকরো মাংস  ঔষধের মত পানি দিয়ে হলেওখেতে হত। কুরবানীর ঈদের সাধারণত রোজার ঈদের মতো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে দূরদূরান্তে বেড়ানো হতো না।  কুরবানীর সময় বাড়ির সকলের শ্রেণী মত দায় দায়িত্ব ছিল ।কেউ লিস্ট তৈরি করা ,কেউ পৌঁছে দেওয়া ,কেউ মাংস কাটা কেউ পশুর বুড়ি ও পা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এটা নিতান্ত কঠিন কাজ এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল ।

আজ প্রযুক্তির যুগে,জীবনের প্রয়োজনে সেই সব স্মৃতি থেকে অনেক দূরে। মনে পড়ছে সেইসব বন্ধুদের কথা।এইসব আত্মীয়স্বজন সেইসব পাড়া-প্রতিবেশী , নাম বললে নামের শেষ হবে না হয়তো দু একটা নাম মনেও আসবে না। এখন পর্যন্ত বাবা, মা, চাচা,দাদি,দাদা, ফুফু,খালা,মামা,সহ কত লোককে হারিয়েছে আমাদের মধ্য থেকে । গ্রামের হিন্দু -মুসলিম কত বড়, কত গুরুজন কত কে হারিয়েছি তাদের কথা মনে হলে এখনো ফিরে যাই সেই সময়ে।

কিন্তু স্মৃতির কোঠায় এখনো অমলিন সেই সব স্মৃতি। মনে হলে চোখের মধ্যে স্মৃতিগুলা ভেসে  ওঠে। জানিনা হয়তো এভাবে আর ঈদ হয় কিনা। পার্থক্য তো থাকবে। আমি আজ থেকে ৩০ বছর আগের সেই স্মৃতিগুলোর কথা  মনে করার চেষ্টা করছি।  নিজের  প্রিয় জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে, ২০০ বছরের পুরাতন,  প্রিন্স অফ ওয়েলস এর একটি  বাড়ির, ঝলমলে উজ্জ্বল একটি কামরায় বসে আছি। কিন্তু মন পড়ে আছে সেই মায়াময় গ্রামে,  সেই পুরাতন সালদিগা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ,টিনের চাল, টিনের হাফ বেড়া, মাঝখানে কোন বেড়া ছাড়া সব গোলো শ্রেণী একই সাথে,স্যারদের কড়া শাসন, মসজিদের দিঘী, হাফিজ সাহেবের বাড়ি ( যেটা পুরোটাই হচেছ আামাদের খেলার মাঠ) প্রিয় মসজিদ , ফরিদ উদ্দিন মেছাবের দরাজ কন্ঠের তিলাওয়াত, আমাদরকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা, খেলার মাঠ,ফলমুল খাওয়া, বিশেষ করে আম কুড়ানো, নৌকা বাওয়া, কতকিছু। আামাদের বখরা ঈদের সাথে এগুলো অবিচ্ছেদ্য ।  

তখন এরকম মোবাইল, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ফেইসবুক, টুইটার এগুলা ছিল না। এখন সবগুলা আনন্দ হয়ে গেছে ইন্টারনেট কেন্দ্রিক বা ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা। আগে আনন্দগুলো ছিল কৃত্রিম এবং অমলিন। হয়তো এখনো আছে কিছু আনন্দ ,কিছু স্মৃতি ইন্টারনেট কেন্দ্রিক এরকম  প্রাকৃতিক।

স্মৃতির পাতায় হয়তো এখনো দাগ কেঠে যাচ্ছে কত নতুন স্মৃতি,নতুন কোন কমল হৃদয়ে। নতুন আবেগে হয়তো আরো ৩০ বছর পরে সেগুলো লেখা হবে। থাকবে না কোন মিল আজকের আমার এ লেখার সাথে।কিন্তু যুগ যুগ ধরে এরকম স্মৃতিগুলো থাকবেই। বেঁচে থাকুক মায়া মমতা ও মানবতা।

রুহুল আলম
লেখক ও শিক্ষক 

user
user
Ad
Ad